আমরা সবাই কম-বেশী নেটওয়ার্ক বা নেটওয়ার্কিং কথাটির সাথে পরিচিত। নেটওয়ার্ক হলো এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে লোকজন দূরবর্তী অন্য কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারে বা তথ্য আদান-প্রদান করাতে পারে। একমাত্র কার্যক্ষম ও নির্ভরযোগ্য টেকনোলজিই মানুষের সমস্ত চাহিদা মিটিয়ে নেটওয়ার্ককে মানুষের সর্বোচ্চ ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারে। আর এজন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এই খাতের উন্নয়নে নানা ধরণের নতুন প্রযুক্তি ও নতুন ডিভাইস তৈরী করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে। এই নতুন প্রযুক্তি ও নতুন ডিভাইসগুলোর সফল ব্যবহারই পারে একটি নেটওয়ার্ককে মানুষের ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তুলতে।
নেটওয়ার্ক যোগাযোগ শুরু হয় একটি ছোট তথ্য বা ম্যাসেজ থেকে যা একজন প্রেরক পাঠায় কোন প্রাপকের নিকট। এবং এই প্রেরক ও প্রাপকের মাঝখানে থাকে একটি মিডিয়া যার মধ্য দিয়ে এই তথ্য আদান-প্রদান হয়ে থাকে। সুতরাং আমরা বলতে পারি, নেটওযার্কে যোগাযোগের তিনটি প্রধান উপাদান হলো প্রেরক, প্রাপক ও মিডিয়া বা মাধ্যম। মিডিয়াম বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে ক্যাবল বা ওয়্যারলেস ট্রান্সমিশনকে।
নেটওয়ার্কের এই উপাদানসমূহ আবার দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত। একটি হলো হার্ডওয়্যার উপাদান এবং অন্যটি সফটওয়্যার উপাদান। ডিভাইস এবং মিডিয়া হলো হার্ডওয়্যার উপাদান, যেমনঃ পি.সি, সুইচ, হাব, ক্যাবল ইত্যাদি। অন্যদিকে সফটওয়্যার উপাদান হলো কিছু সার্ভিস বা প্রসেস (এককথায় সফটওয়্যার) যা ডিভাইসসমূহের মধ্যে রান করে (চলমান থাকে)।
নেটওয়ার্ক ডিভাইসসমূহকে আবার দুইভাগে ভাগ করা হয়। এক. End Device দুই. Intermediary Device
End Device গুলো হলো কম্পিউটার, ল্যাপটগ, সার্ভার, প্রিন্টার, আই.পি ফোন, আই.পি ক্যামেরা, পি.ডি.এ ইত্যাদি। End Device গুলোকে আবার Host ও বলা হয়ে থাকে। আর এই Host ই হলো নেটওয়ার্ক যোগাযোগের প্রেরক ও প্রাপক, এবং এদের প্রত্যেকের আলাদা পরিচয় বা এ্যাড্রেস থাকে। যখন কোন প্রেরক Host অন্য কোন প্রাপক Host এর নিকট তথ্য/ডাটা পাঠায় তখন এই এ্যাড্রেস ব্যবহৃত হয়।
End Device এর পাশাপাশি নেটওয়ার্কে কিছু Intermediary Device ও ব্যবহৃত হয়ে থাকে যা End Device সমূহকে নেটওয়ার্কে সংযুক্ত করে এবং ডিভাইসসমূহের মধ্যে ডাটার আদান-প্রদান নিয়ন্ত্রন করে থাকে। যেমনঃ সুইচ, হাব, রাউটার, ওয়্যারলেস একসেস পয়েন্ট ইত্যাদি।
আমরা আগেই বলেছি নেটওয়ার্কে তথ্য আদান-প্রদান হয় মিডিয়ার মধ্য দিয়ে। আধুনিক কম্পিউটার নেটওয়ার্কে প্রধানত তিন ধরণের মিডিয়া ব্যবহৃত হয়। ১. Metallic Wire ২. Glass or Fiber ৩. Wireless Transmission
শ্রেণীভেদে এই মিডিয়ামগুলোর তথ্য আদান=প্রদানের ক্ষমতা বিভিন্ন হয়ে থাকে। একজন নেটওয়ার্ক প্রফেশনাল যখন তার কাজের জন্য মিডিয়াম নির্বাচন করবেন তখন তাকে নিম্নোক্ত কয়েকটি বিষয় বিবেচণায় রাখতে হবে। ১. নেটওয়ার্কের দূরত্ব। ২. নেটওয়ার্কের পরিবেশ। ৩. ডাটার পরিমাণ এর্ং ডাটা ট্রান্সমিশনের গতি। ৪. ইন্সটলেশনের খরচ।
নেটওয়ার্ক কাঠামো কয়েকটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। বিষয়গুলো হলোঃ ১. নেটওয়ার্কের আকার ২. ইউজার সংখ্যা ৩. নেটওয়ার্ক সার্ভিসের সংখ্যা ও তার ধরণ
একটি ছোট এলাকা বা ভবন নিয়ে যে নেটওয়ার্ক গঢ়ড় উঠে তাকে LAN (Local Area Network) বলে। এখানে Host সংখ্যা দুই থেকে শুরু করে একটি সীমিত সংখ্যা পর্যন্ত হতে পারে।
যথন কোনো কোম্পানির বিভিন্ন স্থান ও দূরত্বে একাধিক অফিস থাকে তখন তারা ইন্টারসেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আই.এস.পি) এর মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানের অফিসকে সংযুক্ত করে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। এই ধরণের নেটওয়ার্ককে WAN (Wide Area Network) বলে। একটি WAN হলো একাধিক LAN এর সমষ্টি। এই WAN কে ম্যানেজ করার জন্য একজন দক্ষ নেটওয়ার্ক প্রফেশনাল এর প্রয়োজন হয়।
LAN ও WAN এর যোগাযোগ ছাড়াও দৈনন্দিন জীবনে আমাদের আরো অনেক প্রয়োজন রয়েছে। যেমনঃ আমেরিকায় থাকা কোন বন্ধুকে ই-মেইল করা, কোন ওয়েব সাইট ব্রাউজ করা, অনলাইনে কারো সাথে চ্যাট করা ইত্যাদি। আর এজন্য আমাদেরকে যে নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হতে হয় তা হলো Internet. Internet হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও বহুল ব্যবহৃত নেটওয়ার্ক।
কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা আমাদের দৈনন্দিন জীবন – দুই জায়গাতেই সব ধরণের যোগাযোগগুলো হয়ে থাকে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসারে। আর এ নিয়মসমূহকে আমরা প্রটোকল বলতে পারি। ব্যক্তিগত যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমরা প্রতিদিন বিভিন্ন নিয়ম অনুসরণ করে থাকি। টেলিফোন যোগাযোগের ক্ষেত্রে যে নিয়ম মানা হয় পত্র যোগাযোগের ক্ষেত্রে আর সে নিয়ম কাজ করে না। তাহলে একবার চিন্তা করে দেখুন এরকম কত শত নিয়ম পৃথিবীতে বিদ্যমান। যেমন: আমরা যখন কারো সাথে ফেস-টু-ফেস কথা বলি তখন বিভিন্ন দিক খেয়াল রাখতে হয়। যার সাথে কথা বলি সে যে ভাষা জানে আমাকেও সেই ভাষায় কথা বলতে হবে, কথার ভলিউম এমন হতে হবে যাতে করে সে কথা শুনতে পায়, কথা বলার সময় তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে হবে, শুধু নিজে কথা বললেই হবে না তাকেও কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। ঠিক এমনি নেটওয়ার্ক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও এরকম অসংখ্য নিয়ম বা প্রটোকল বিদ্যমান।
একটি প্রেরক ও প্রাপক ডিভাইসের মধ্যে সফলভাবে ডাটা আদান-প্রদানের জন্য একাধিক প্রটোকলের প্রয়োজন হতে পারে। আর পরষ্পর সম্পর্কযুক্ত একাধিক প্রটোকলের একটি গ্রুপকে বলা হয় প্রটোকল সুইট (Protocol Suite)। আবার নেটওয়ার্ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সবগুলো প্রটোকল একই সাথে ব্যবহৃত হয় না বরং একটির কাজ শেষ হলে অন্যটির কাজ শুরু হয়। ব্যাপারটিকে আমরা “একের পর এক” অর্থাৎ এক Stack আকারে কল্পনা করতে পারি।
প্রটোকল সুইট এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে একটি Web Server ও একটি Web Browser এর মধ্যকার যোগাযোগ। যখন কোন কম্পিউটার এর Browser থেকে কোন Web Server এর নিকট রিকোয়েষ্ট পাঠানো হয় তখন এই কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য বিভিন্ন প্রটোকলসমূহ কাজ করে। যেমনঃ প্রথমে Application লেয়ারের HTTP প্রটোকলের মাধ্যমে ডাটা ট্রান্সমিশনের সূচনা হয়। তা পরবর্তীতে Transport লেয়ারে এসে TCP প্রটোকলের মাধ্যমে ছোট ছোট খন্ড বা Segment এ বিভক্ত হয়। পরবর্তীতে Internet লেয়ারের IP প্রটোকলের মাধ্যমে এ্যাড্রেস সংযুক্ত করে এবং Network Access লেয়ারের MAC প্রটোকলের মাধ্যমে উপযুক্ত মিডিয়ামের মধ্য দিয়ে ডাটা প্রবাহিত হয়।
এই লেয়ারভিত্তিক নেটওয়ার্ক যোগাযোগের জন্য একটি বহুল ব্যবহৃত Layered Model হলো TCP/IP মডেল। TCP/IP মডেল হলো এমন একটি প্রাটোকল মডেল যা প্রতিটি লেয়ারের প্রটোকলসমূহের কার্যবলী নির্ধারণ করে। আর TCP/IP মডেলকে আরো ভালোভাবে বুঝার জন্য পরবর্তীতে আবির্ভূত হয়েছে একটি Reference Model যা OSI Model হিসেবে পরিচিত। ডাটা ন্টেওয়ার্ক ডিজাইন ও ট্রাবলশ্যুটিং এর কাজে এই OSI Model ব্যবহৃত হয়।
TCP/IP মডেল অনুসারে একটি সফল নেটওয়ার্ক যোগাযোগের প্রয়োজনীয় ধাপগুলো হলোঃ
১. প্রেরক ডিভাইসের Application লেয়ারে ডাটা ট্রান্সমিশনের সূচনা হয়। অতঃপর তা Transport লেয়ারে পাঠায়। ২. Transport লেয়ার এ ডাটাকে Segment এ বিভক্ত করে এবং Internet লেয়ারে পাঠায়। ৩. Internet লেয়ার প্রতিটি Segment কে Packet এ বিভক্ত করে এবং প্রতিটি Packet এর সাথে প্রেরক ও প্রাপকের ঠিকানা (আই.পি এ্যাড্রেস) সংযুক্ত করে। ৪. সবশেষে Network Access লেয়ার Packet সমূহকে Frame এ বিভক্ত করে এবং উপযুক্ত মিডিয়ামের মধ্য দিয়ে bits আকারে ডাটা প্রবাহিত করে। উপরিউক্ত প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় Encapsulation.
যখন প্রেরক ডিভাইস থেকে প্রেরিত কোন Frame প্রাপক ডিভাইসে পৌছায় তখন ঘটে বিপরীত ঘটনা। ১. প্রথমে Network Access লেয়ার Frame গুলোকে Packet এ পরিণত করে। ২. তারপর Internet লেয়ার Packet গুলোকে Segment এ পরিণত করে। ৩. Transport লেয়ার Segment গুলোকে একত্রিত করে Data তে পরিণত করে। ৪. এবং সবশেষে Application লেয়ার উক্ত Data কে উপযুক্ত প্রোগ্রামের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর নিকট তুলে ধরে। এ প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় Decapsulation. ইহা Encapsulation এর ঠিক বিপরীত কাজ করে।
সুতরাং Encapsulation হলো Data ---> Segment ---> Packet ---> Frame ---> Bits এবং Decapsulation হলো Bits ---> Frame ---> Packet ---> Segment ---> Data ধন্যবাদ সবাইকে।